স্মার্ট কার্ড (জাতীয় পরিচয়পত্র) বিতরণে নতুন প্রজ্ঞাপন জারীর পরও নানা অজুহাতে নগদ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় জড়িত রয়েছে নির্বাচন অফিস এবং সোনালী ব্যাংকের দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। নতুন প্রজ্ঞাপনের বিষয়টি কৌশলে গোপন রেখে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করে আসছে চক্রটি। এ বিষয়ে নতুন প্রজ্ঞাপন জারীর বিষয়টি জানার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ২৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় সর্বমোট ১ লাখ ১২ হাজার ১৯৯ জন নাগরিকের হাতে স্মার্টকার্ড বিতরণের লক্ষে কার্যক্রম শুরু হয়।
রাজাপালং ইউনিয়নের ভোটারদের স্মার্ট কার্ড বিতরণের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু হয়। শুরু থেকে স্মার্ট কার্ড বিতরণ নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে ভুক্তভোগী লোকজন। মানুষের ভোগান্তি কমাতে গত ৮ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জাতীয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক ( প্রশাসন) মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান স্বাক্ষরিত একটি নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করেন। পূর্বের প্রজ্ঞাপনের নিয়ামাবলি বাতিল করেন। এই প্রজ্ঞাপনে হারানো কার্ড দিয়ে স্মার্ট কার্ড নিতে যে ফি গুনতে হতো তা বাতিল করা হয়। নতুন প্রজ্ঞাপন জারির পরও তা গোপন রেখে স্মার্ট কার্ড বিতরণে সাধারন মানুষকে বিভিন্ন হয়রানিসহ নগদ অর্থ আদায় করে আসছে নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টরা। নতুন প্রজ্ঞাপনের পর গত বুধবার (১৮ অক্টোবর) উখিয়ার হলদিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে স্মার্ট কার্ড বিতরণ করা হয়। বিতরণকালে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ব্যাংক ফি এর নামে নগদ অর্থ আদায়সহ হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। ওই দিন সোনালী ব্যাংক উখিয়া শাখার মাস্টাররোলের কর্মচারী মোহাম্মদ রায়হানকে দিয়ে গণহারে ৩৫০ টাকা করে আদায় করা হয়েছে। আদায়কৃত অর্থ ব্যাংক ব্যবস্থাপকের যোগসাজশে নির্বাচন অফিসের একাধিক কর্মকর্তা মিলে রাজস্বে জমা না করে হরিলুঠ করে নেয়। অথচ নতুন প্রজ্ঞাপনে হারানো ফি বাবদ অর্থ আদায়ের কোন বিধান নেই। প্রতিবেদকের কাছে ওই দিনের অর্থ আদায়সহ সাধারণ মানুষকে হয়রানির কিছু ভিডিও সংরক্ষিত রয়েছে।
এদিকে রাজাপালং এবং রত্নাপালং এর স্মার্ট কার্ড বিতরনে উখিয়া উপজেলার সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইরফান উদ্দীনের সরব উপস্থিতি পরিলক্ষিত হলেও হলদিয়া পালং এর স্মার্ট কার্ড বিতরণের ১ম দিন প্রজ্ঞাপন জারীর বিষয় জানাজানি হলে ২য় দিন হতে আর দেখা যায়নি। দেখা যায়নি ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকেও।
এছাড়া কার্ড বিতরণের সময় প্রতিটি ভেন্যু নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট চক্রের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকায় কন্ট্রাক্ট নিয়ে কার্ড নিতে আসা সাধারণ মানুষকে স্ক্যান, কালার ফটোকপি, লেমিনেটিংসহ অন্যান্য কাজ ওই মাঠে উপস্থিত লোকদের কাছ থেকেই করানোর জন্য বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু তাই না, মাঠে গিয়ে এনআইডি নম্বর বা নাম দিয়ে একটি টোকেন নিতে হচ্ছে সকলকে। যা পরবর্তীতে লাইনে দাঁড়িয়ে নির্ধারিত বুথে গিয়ে দেখালে কার্ড দিয়ে দেয়া হয়। ওই টোকেনটি নিতেই এক শ’ টাকা জমা দিতে হচ্ছে মাঠে বসানো বিভিন্ন ডিভাইস পরিচালনাকারী লোকের কাছে। মজার বিষয় হলো কে বা কারা কার্ড বিতরণের আগেই স্থানীয়ভাবে মাঠ ইজারা নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে। তাদের লোকই ভোটার তালিকা থেকে নাম বের করার জন্য প্রতিজনের কাছ থেকে ১০০ টাকা, ফটোকপি, লেমিনেটিংসহ অন্যান্য কাজে ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত একই সঙ্গে হারানো কার্ড ফেরত নিতে সরকারীভাবে ৩৪৫ টাকা নির্ধারিত খরচ হলেও ভেন্যু থেকেই নেয়া হচ্ছে ৫৬০ টাকা পর্যন্ত। এমনকি লাইনে দাঁড়ানো নিয়েও রয়েছে অর্থবাণিজ্য। কেউ যদি লাইনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে না চান তাহলে টাকা দিলেই তার কার্ড ভেতর থেকে এনে নির্ধারিত গ্রাহকের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে বা হয়।
এদিকে, ওই চক্রই আবার ইজিবাইক, সাইকেল ও ভ্রাম্যমাণ দোকান কোথায় কত টাকার বিনিময়ে বসবে তাও নিয়ন্ত্রণ করে।
অনিয়মের বিষয় নিয়ে দৃষ্টি আর্কষন করা হলে উখিয়ায় কর্মরত কয়েকজন সংবাদকর্মী জানিয়েছেন, এইসব অনিয়মের বিষয় তাদের নজরে আসবে তাই, আগে থেকে তাদের স্মার্ট কার্ড উপজেলায় বিতরণ করেছে। পরে অনিয়মের বিষয়টি তাদেরও নজরে এসেছে।
রাবেয়া খাতুন (ছদ্বনাম) বলেন, আমার পূর্বের আইডি কার্ডে ভুল থাকায় আমি পূণরায় সংশোধন করে আরেকটি আইডি কার্ড সংগ্রহ করি। এটা জমা দিয়ে স্মার্ট কার্ড নিতে চাইলে তারা বলেন, হয় পূর্বের আইডি কার্ড লাগবে না হয় ৩৫০ টাকা জরিমানা দিয়ে স্মার্ট কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। তিনি ওই দিন স্মার্ট কার্ড না নিয়ে ফেরত যান।এই রকম অভিযোগ অহরহ।
আলী হোসেন (ছন্ম নাম) বলেন, সরকারী কার্ড নিতে তো কোন টাকা লাগার কথা না, তা হলে দিব কেন। এ কথা বললে তার কার্ডটি কেড়ে নিয়ে তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেয়া হয় বলে অভিযোগ তার।
এ বিষয়ে উখিয়া উপেজলা নির্বাচন কর্মকর্তা (অঃদা) এস এম মহিউদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, স্মার্ট কার্ড বিতরণে কোন ধরনের অনিয়ম হচ্ছে না। তিনি নিজে তদারকি করছেন। নতুন প্রজ্ঞাপনে অর্থ আদায়ের বিধান নেই, তবুও কেন সোনালী ব্যাংক উখিয়ার শাখায় মাস্টাররোলে কর্মরত মোহাম্মদ রায়হানকে দিয়ে অর্থ আদায় করা হয়েছে প্রশ্ন করা হলে তিনি তা কৌশলে এড়িয়ে যান এবং মাঠ কেনা নিয়ে অর্থ বাণিজ্যের বিষয়ে কিছু জানেন না বলেও মন্তব্য করেন।
গত বুধবার ১৮ অক্টোবর হলদিয়ার ১ নং ওয়ার্ডে সাধারণ মানুষকে হয়রানিসহ অর্থ আদায় করা হয়েছে এমন প্রশ্ন করা হলে ওই দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিনি মাঠে ছিলেন দাবি করে প্রশ্নটি এড়িয়ে যান।
শনিবার দুপুরে মুঠোফোনে কথা হয় উখিয়ার হলদিয়া ১ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য এম. মনজুর আলমের সাথে। তিনি বলেন, নতুন প্রজ্ঞাপনের বিষয়টি গোপন রেখে তার ওয়ার্ডে স্মার্ট কার্ড বিতরণে সাধারণ মানুষকে হয়রানিসহ অর্থ আদায় করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নতুন নিয়ম জানা ছিল না বলে তখন কোন প্রতিবাদ করি নাই। পরে জানতে পেরে আদায়কৃত অর্থ ফেরত দেয়ার দাবি জানিয়েছি নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের। ফেরত না দিলে নির্বাচন কমিশন বরাবর অভিযোগ দায়ের করব।
এ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার দুই দফা সোনালী ব্যাংক উখিয়া শাখার ম্যানেজার মো. রুহুল আমিন এর সাথে যোগাযোগ করে এই পর্যন্ত স্মার্ট কার্ড বিতরণে কত টাকার চালান জমা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি একটু পর তথ্য দেয়ার কথা বলে কল কেটে দেন। পরে তিনি নিজ থেকে যোগাযোগ না করলে প্রতিবেদক দুই ঘন্টা পর দ্বিতীয় দফা যোগাযোগ করলে তিনি তথ্য না দিয়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।
মোহাম্মদ রায়হান নামের একজন ব্যাংকের প্রতিনিধি হয়ে অর্থ আদায় করেছেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, নির্বাচন অফিস সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা করেছি মাত্র।
শনিবার বিকালে এ প্রসঙ্গে নবাগত কক্সবাজার জেলা নির্বাচন অফিসার মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে নতুন প্রজ্ঞাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি অর্থ আদায়সহ হয়রানির বিষয়টি অবগত নন বলে দাবি করেন। তবুও তিনি বিষয়টি খোঁজ নিবেন।